Bera Utsav মুর্শিদাবাদের জনপ্রিয় উৎসব বেরা। ৩০০ বছরেরও পুরোনো এই উৎসব। ১৯২০ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ সিভিল সার্জেন্ট মেজর জেএইচ থালের (Walsh J. H. Tull Major) লেখা “ এ হিস্ট্রি অফ মুর্শিদাবাদ” বইতে লিখেছেন, নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ তার সময়েও বেরা উৎসবের আয়োজন করতেন। যদিও ইতিহাসবিদ গোলাম হোসেন দাবি করেছেন, নবাব সিরাজ উদ দৌলা বেরা উৎসব চালু করেছেন। “দা মোহামাডানস অফ ইস্টার্ন বেঙ্গল” (The Muhammadans of Eastern Bengal) বইতে ড. জেনস ওয়াইসও একই মত পোষণ করেছেন। ভোলানাথ চন্দ্র ১৮৪৫ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের যে বৃত্তান্ত রেখে গিয়েছেন তার “দি ট্রাভেল্স্ অফ এ হিন্দু’ (১৮৬৯) বইতে ৮২ পৃষ্ঠায় তিনি মুর্শিদাবাদের বেরা-উৎসবের বিবরণে বলেছেন, সিরাজই মুর্শিদাবাদে এই উৎসবের প্রবর্তক। বেরা যদিও পার্সি শব্দ পার্সি ভাষায় বেরা শব্দের অর্থ নৌকা।
Bera Utsav শোনা যায়, নবাবরা নৌকার মাধ্যমে দিল্লির সম্রাটকে উপহার পাঠাতেন। সেই নৌকা হত সুসজ্জিত। নৌকার যাত্রা নিরাপদ করার জন্য করা হত প্রার্থনা। একই দিনে হাতি, ঘোড়া নিয়ে র্যালি হতো। দাগা হতো তোপ। হতো গান বাজনার আয়োজনও। সেই প্রথাকে জীবিত রাখতেই ভাগীরথীর তীরে আজও বেরা উৎসবের আয়োজন করা হয়। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার হয় বেরা উৎসব।
“বাংলার লোক-উৎসব ও লোকশিল্প” বইতে হীরেন্দ্রনাথ মিত্রের দেখা বেরা উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। হীরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন, “ নক্ষত্র-চর্চিত বিশাল আকাশখানা বর্ষাস্ফীত ভাগীরথীর জলে মুখ দেখবার জনো ঝুঁকে পড়লেও আজ রাত্তিরে তার সুন্দর মুখে নয়, আর এক অন্য রূপে ভাগীরথী রূপময়ী হয়ে উঠেছে। বাঁশ আর কলাগাছ দিয়ে তৈরি বিচিত্রগঠন প্রকাণ্ড ভেলা মোমবাতির আলোর গহনা পরে ভাগীরথীর জলে ভাসছে। বাখাবি, চেঁচাবির কাঠামোতে রঙিন কাগজে, অভ্রে, রাংতায় সাজানো তার মিনার, ছত্রি, বারান্দা, তোরণ। তাদের চুড়োয় চুডোয় নিশান, ময়ূর, আলোর ঝালর। বেলোয়ারি ঝাড়-লগ্ঠনের অন্রের ঢাকনায় ঝোলানো মোমবাতির আলোর কারুকর্মে ভেলার সর্বাঙ্গ ভূষিত। জলের ঢেউ-এ ভেলা দূলছে। সেই দোলাতে চুড়ো থেকে তলা পর্যস্ত বেলোয়ারি আলোর সাজও দুলছে ঝিলিক তুলে। এই আলোর ভেলা আর তার কম্পমান প্রতিবিশ্বিত রূপটিকে বুকে নিয়ে রাতের কালো ভাগীরথী স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে যেন”।
Bera Utsav যারা বেরার খোঁজ রাখেন তাঁরা জানাচ্ছেন, ইসলাম পুর্ববর্তী সিন্ধে খাজা খিজিরের উল্লেখ রয়েছে। ইসলাম পরবর্তী কালেও রয়ে গিয়েছে জলদেবতা বলে কথিত খাজা খিজির নামে এক পীরের উপাসনার কথা। সেই খাজা খিজিরের উদ্দেশ্যে বেরা উৎসবে ভেলা উৎসর্গ করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
নবাব নাজিমদের হাজারদুয়ারী প্রাসাদের সামনে তোপখানার ঘাট থেকে ভাসানো হয় বেরা উৎসবের ভেলা । আগে তোপখানার কামান থেকে তোপ দেগে বেরা ভাসানোর লগ্ন ঘোষণা হওয়ামাত্র ভেলার তীরের সঙ্গে বেঁধে রাখা দড়ি কেটে দেওয়া হতো। বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, এই উৎসবে ভেলাটিই কিন্তু সর্বস্ব নয়। চারটি কাঠামোতে কালো কাগজ দিয়ে যে চারটি ময়ূরপঙ্খী তৈরি করা হয় আসল উৎসব সেটা নিয়ে। ভেলার মাঝখানে থাকে সেই ময়ূরপঙ্খী চারটি।
Bera Utsav হীরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখছেন, “ ময়ূরপঙ্খীকে ওয়াসিফ মঞ্জিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নবাববাড়ির লোকজন মকরের মুখে ফুলের মালা বেঁধে দেন। একে বলে সেহারা বাধা। তারপর খাজা খিজিরের জন্যে সুজির পায়েস, রুটির সিন্নি আর সোনার পিদ্দিম নিয়ে বাজনাবাদ্যি করে মিছিল আসে তোপখানার ঘাটে। ময়ূরপঙ্খী চারটি ভেলার মাঝখানে স্থাপন করা হয়। তারপর খাজা খিজিরের নামে সোনার পিদ্দিম আর ভেলার সব মোমবাতি জ্বেলে দেওয়ার রীতি । তোপখানা তোপ দাগার সঙ্গে সঙ্গে ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া হয়” ।