ভাগীরথীর পূর্বতীরে একটি বিরাট বর্গাকার মাঠ। যে মাঠের চারদিকে তৈরি হয়েছিল দুর্গ। পুরনো এক সেনানিবাস। বহু ইতিহাসের সাক্ষী। মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুরে যে স্থানটি ব্যারাক স্কোয়ার বা স্কোয়ার ফিলড নামেই পরিচিত। বহরমপুর কোর্ট রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে মাত্র দেড় কিমি দূরে বহরমপুর সেনানিবাসের কেন্দ্রস্থল ছিল এটিই। বহরমপুরের বুকে বিশালাকার এই মাঠের চারপাশে সেনানিবাস তৈরির উদ্দেশ্য কী ছিল?
ইতিহাস বলছে, পলাশির যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন ব্রোহিয়ার, ফোর্ট উইলিয়ামের অধিকর্তা মি. ড্রেকের কাছে ‘ বহরমপুর সমতলে’ একটি দুর্গ নির্মাণের প্রস্তাব পাঠান। বলা হয়, রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি একটি শক্ত সামরিক ঘাঁটি থাকলে মুর্শিদাবাদের নবাবের ওপর নজর রাখা এবং তাঁকে নিয়ন্ত্রনে রাখা সহজ হবে। এই ব্যাখ্যা দিয়েই ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকবর্গের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কোম্পানির কর্তারা প্রথমে এই প্রস্তাব নাকচ করলেও ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মীর কাশিমের সঙ্গে কোম্পানির সংঘর্ষের পর লন্ডনের কর্তারা এই প্রস্তাবের যৌক্তিকতা স্বীকার করেন এবং বহরমপুরে সেনা নিবাস তৈরির অনুমতি দেন। সেই মতো ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্গের নির্মাণকার্জ আরম্ভ হয়। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয়। প্রধান বাস্তুকার ছিলেন কর্নেল এ ক্যাম্পবেল। এটি বেঙ্গল আর্মি-র উত্তর সীমান্তে ঘাঁটি রুপে পরিগণিত হয়েছিল।
ব্যারাক স্কোয়ারের পশ্চিম দিকে দুটি অঞ্চলে বিভক্ত মোট আটটি বিশাল দ্বিতল গৃহ। যা সেনাধ্যক্ষ ও অন্যান্য উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মচারীদের বাসস্থান হিসেবে তৈরি হয়েছিল। উত্তর এবং দক্ষিন দিকেও দুটি অঞ্চলে বিভক্ত দ্বিতল বাড়ি নির্দিষ্ট ছিল প্রধানত ইউরোপীয় সৈনদের জন্য। যদিও ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বহরমপুর থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয় সেনানিবাস। পূর্বদিকের বাড়িগুলি ছাড়া বর্তমানে অন্য বাড়িগুলি জেলার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের বাসস্থানে পরিণত হয়েছে। ব্যারাক স্কোয়ারের পশ্চিম দিকের দক্ষিন প্রান্তে প্রাসাদের মতো এই বাড়ি দুটিতে বাস করেছিলেন লর্ড ক্লাইভ। বর্তমানে এই বাড়ি দুটি জেলা সমাহর্তার বাসস্থান এবং সার্কিট হাউজ। তৃতীয় বাড়িটি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের বাসস্থান। চতুর্থ বাড়িটি ছিল জেলার প্রধান বিচারপতির বাসস্থান যদিও বাড়িটি সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়ে সেখানেই নির্মিত হয়েছে জেলা গ্রন্থাগার। জেলা জজের বাসস্থানও নির্মিত হয়েছে পাশেই। আরেকটি বাড়ি এখন স্থানীয় মহিলা কলেজের ছাত্রী নিবাস।
এখানেই শেষ নয়। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই ব্যারাক স্কোয়ারকে ঘিরে থাকা রাস্তা, বাড়ি। একটা সময় ব্যারাক স্কোয়ারের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে ছিল ‘অস্ত্রাগার’। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই অস্ত্রাগার সিপাহিদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছিল। উত্তর দিকের বাড়িগুলির কয়েকটি এখন সরকারি পদস্থ কর্মচারীদের বাসস্থান। পূর্ব প্রান্তে ছিল উপাসনা গৃহ এখন যেটি সরকারি ডাকবাংলো। পূর্ব দিকের উত্তর প্রান্তের বিশাল ভবনটি টেক্সটাইল কলেজ। মধ্যেরটি মহকুমা আদালত ছিল এবং রেজিস্ট্রি অফিস ও অন্যান্য সরকারি কার্যালয়। স্কোয়ারের দক্ষিনে বিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার। ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যায়, এই সেনা নিবাসেই ভারতবর্ষের প্রথম সংগঠিত স্বাধীনতা সংগ্রাম- সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি এখানে অবস্থিত ১৯ তম দেশীয় পদাতিক বাহিনী বিদ্রোহ করে। যদিও সেই বিদ্রোহ অবিলম্বেই শান্ত হয়ে যায়। ঐ ঘটনার শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে মাঠের উত্তর পশ্চিম কোণে একটি স্মারক স্তম্ভ স্থাপিত হয়। ব্যারাক স্কোয়ারের প্রাচীন বাড়িগুলি আজ বেশিরভাগই জীর্ণ অবস্থায়। কয়েকটি বাড়ি ধ্বংসও হয়েছে।