Thursday, December 19, 2024

মুর্শিদাবাদের গর্বের সম্পদ হাজারদুয়ারী প্যালেস

নিজামত কেল্লা জেলার সবচেয়ে সুন্দর দ্রষ্টব্য স্থান  । প্রশস্ত   বহতা নদী ভাগীরথীর  ধারে এমন মনোরম স্থান বোধকরি দ্বিতীয়টি নেই ।  নদীর উত্তর থেকে দক্ষিণ তীরে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে  প্রায়  ৪১  একর বা  ১২৩   বিঘে জমি নিয়ে এই কেল্লা ।  এই কেল্লার  মধ্যেই আছে হাজারদুয়ারী প্যালেস মিউজিয়াম ,    নিউ  প্যলেস ,   তিনটি মসজিদ।  ১৮২৯   থেকে    ১৮৩৭  এই ৯ বছরে  ১৬  লক্ষ টাকা ব্যয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ম্যাকলিওড ডানকান তৈরি করেন হাজারদুয়ারী প্যালেস।   আসল নকল মিলিয়ে হাজারদুয়ার যুক্ত   ৮০  ফুট উঁচু এক ত্রিতল প্রাসাদ তৈরি পাশ্চাত্য রীতিতে ডানকানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ।  আসল নকল মিলিয়ে   ৯০০  টি  দরজা হলেও একশটি কৃত্তিম দরজা রয়েছে হাজার দুয়ারী  প্রাসাদে আর তা থেকেই এই নামকরণ।

 

হাজারদুয়ারি প্রাসাদ আয়তনে   ৪২৫ ′×২০০×৮০ ।    প্রাসাদের ভেতর দিকে চার কোণে চারটি ঘোরানো লোহার সিঁড়ি । তাছাড়া ভেতর দিকে  আরও কয়েকটি এক তলা থেকে দোতলা ,   দোতলা থেকে তিনতলায় যাওয়ার সিঁড়ি রয়েছে ।  প্রাসাদের সামনের দিক উত্তরমুখী  ।  ৩৭  টা চওড়া সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হয় ।  প্রাসাদে অনেকগুলি লম্বা থাম ।   নবাবদের বাসস্থান হিসেবে তৈরি হলেও নবাবরা এখানে বাস করেন নি ।  তাই এক সময় একে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়।

 

প্রাচীন মুর্শিদাবাদের স্মৃতি নিয়ে অপরূপ নির্মাণ এই প্রাসাদ এখন মিউজিয়াম  এক ঐতিহাসিক  জাদুঘর বলা যায়  ।  নিচের তলায় রয়েছে তৎকালীন নবাবদের ব্যবহৃত  ২৭০০  টি  অস্ত্রশস্ত্র  ।  যার মধ্যে নবাব সিরাজদৌলার তরবারি থেকে সেই ছুরিকা ,  যে ছুরিকা দিয়েই মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে খুন করেছিল৷।  তাও আজও রক্ষিত আছে হাজারদুয়ারি মিউজিয়ামে  ।  ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞি মহারানী ভিক্টোরিয়ার দেওয়া উপহার রুপোর সিংহাসন।

রুপোর সিংহাসন এই প্যালেসের দোতালায় দেখা যায় আজও কাচের শোকেসে সংরক্ষিত ।   ১৬১  টি  ঝাড় যুক্ত বিশাল বেলোয়ারি ঝাড়বাতির  নিচে সিংহাসনে বসে দরবার পরিচালনা করতেন নবাব।   ঝাড়বাতির আলোয় অতি স্নিগ্ধ ও মনোরম হত দরবার কক্ষ ।   পাশে মন্ত্রণা কক্ষের   লুকোচুরি আয়না,   দেশ-বিদেশ থেকে সংগৃহীত বিশ্ব বিখ্যাত ঘড়ি,   মার্শাল টিপসিয়ান,   রাফায়েল,  ভ্যান ডাইক  প্রমুখ  ইউরোপীয় শিল্পীর  অয়েল  পেন্টিং ,   প্রাচীন নানা ধরনের পাথরের মূর্তি   হাজারদুয়ারীর  আকর্ষক ক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে৷।  ত্রিতল  অর্থাৎ তিন তলায় নবাবি আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন সোনা দিয়ে মোড়া কোরান শরীফ ,  অতি   মূল্যবান  পুঁথিপত্র আইন-ই-আকবরী পান্ডুলিপি সহ অসংখ্য বইয়ের সম্ভার রয়েছে হাজার দুয়ারী প্যালেসে ।

ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসের কিছু বৈশিষ্ট্য নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে এই সংগ্রহশালায়

একতলায় অস্ত্রাগার মহাফেজ খানা ও তোষাখানা দোতালায় গ্রন্থাগারে পুস্তক সংখ্যা প্রায়  ২৪০০০ ।

হাজার দুয়ারি প্রাসাদে নবাব,  দেওয়ান,  নবাবপুত্র  , এজেন্ট দের সকলের তৈলচিত্র যেমন আছে তেমনি আছে নিসর্গ চিত্র , শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন নাটকের দৃশ্য , চিত্র শিকারের দৃশ্য ইত্যাদি এর মধ্যে.   ৩.৫৬ মিটার  × ৪.৮০  মিটার   ক্যানভাসের উপর বিশাল আকারের   ‘  দ্য  বেরিয়াল অফ সার্জন মুর  ‘  ( স্যার জন্ম এর সমাধি )  তৈলচিত্রটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য  । এছাড়াও হাজারদুয়ারির চত্বরে রয়েছে  ১৬৪৭  খ্রিস্টাব্দে জনার্দন কর্মকারের তৈরি   ১৮  ফুট লম্বা  ৮   টন ওজনের   ‘ জাহানকোষা  ‘ বা বিশ্বজয়ী কামান ।  জানা যায় এই কামানে একবার তোপ দাগতে ৩০  কেজি বারুদ লাগত   বাচ্চেওয়ালি কামান নামেও পরিচিত   এটি  ।

 

নবাবদের বাসস্থান হিসেবে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ তৈরি হলেও নবাবরা এখানে বাস করেন নি একদিনও ।  এক সময় একে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়  । ২৬  আগস্ট  ১৯৯০  তারিখে  নবরূপায়িত মিউজিয়াম পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসান উদ্বোধন করেন।

 

কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ বিভাগের অধীনে হেরিটেজ কমিটি পরিচালনা করে বর্তমানে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ মিউজিয়ামটি ।  ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে সংরক্ষণের দায়িত্ব বর্তমানে কমিটির।   পাশাপাশি ওয়াসিফ মঞ্জিল    ( নিউ প্যালেস )   তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে রাজ্য সরকারের বিচার বিভাগের উপর।

Hot Topics

Related Articles