“পুতুল নেবে গো ? পুতুল ?”, হারিয়ে গেছে পুতুল বিক্রির গান। হারিয়ে যাওয়ার পথে মাটির পুতুলও। রাজ্যজুড়ে একসময় নামডাক ছিল খাগড়া সৈদাবাদ এলাকার মাটির পুতুলের। এই এলাকার কারিগরদের বানানো পুতুল শোভা পেত শহরের শৌখিন মানুষের বাড়ি, অফিসে। কিন্তু সময়ের নিয়মেই কদর কমেছে মাটির পুতুলের । কিন্তু এখনও একমনে পুতুল গড়ছেন মহাদেব দাস। টিকিয়ে রেখেছেন খাগড়ার মাটির পুতুল। খাগড়ার মাটির পুতুলের ইতিবৃত্ত লিখলেন দেবনীল সরকার । ছবি তুলেছেন রন্তিম চ্যাটার্জি।
দেশ তখন পরাধীন , বিশের দশকের শুরুতে ‘মধুসূধন দাস’ –এর হাত ধরে খাগড়া তথা বহরমপুর অঞ্চলে মৃৎশিল্প, কাজের রূপ পায়। মধুসূধন যদিও এই অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন না। গোকর্ণ থেকে এই অঞ্চলে আসেন মধুসূধন। বর্তমানে তাঁর চতুর্থ প্রজন্ম ও তাদের পরিবার খাগড়ায় (সৈদাবাদ অঞ্চলে) বসবাস করেন এবং তাঁরা প্রায় সকলেই পেশা হিসাবে মাটির কাজই বেছে নিয়েছেন। এখানে আজ তাদের প্রায় চারটে মাটির কারখানা আছে। সকলেই নিজের কাজের মাধ্যমে পরিচিতি স্থাপন করেছেন সারা জেলায়।
কেউ মূর্তি তৈরিতে দক্ষ কেউ বা মাটির ভাস্কর্য তৈরিতে পটু আবার কারও কল্পনায় রূপ পেয়েছে বহরমপুরের বিখ্যাত ‘কালিকা প্রতিমা’র মূর্তি, কেউ জেলায় বিখ্যাত হয়েছেন ‘ভৈরব’ –এর মায়াময় মূর্তি তৈরি করে। মধুসূধনের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি প্রথম জীবনে কাঠের কাজ করতেন। পরবর্তীকালে তিনি মাটির কাজ শুরু করেন এবং তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক দক্ষতাবলে এই অঞ্চলে মাটির কাজের পসার করেন। তাঁকে খাগড়া তথা বহরমপুর অঞ্চলের মৃৎশিল্পের Pioneer বলা যায়।
পূর্বে এই অঞ্চলের রাজবাড়ি ও জমিদার বাড়িতে রাজপরিবারের চাহিদা অনুযায়ী মূর্তি, মাটির প্রতিমা তৈরির জন্য মুর্শিদাবাদের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম মহুলা (কাঁঠালিয়া অঞ্চল) থেকে শিল্পী নিয়ে আসা হতো রাজবাড়িতে। রাজবাড়িতেই দিনের পর দিন থেকে তারা কাজ করতেন। তখন বারোয়ারি পুজোর প্রচলন ছিল না, তাই প্রতিমা গড়ারও এতো হিড়িক ছিল না। ফলে আজকের সদর বহরমপুরে, যেখানে মৃৎশিল্পের ওপর নির্ভর করে এখন প্রায় কয়েক হাজার লোক জীবিকা নির্ভর করে, সেখানে বিশেষ মাটির কাজের লোক ছিল না, থাকলেও তা হাতে গোণা । তবে উনিশের দশকে থেকে মহুলায় মাটির একচেটিয়া কাজ হতো। তার একটা বড় কারণ মহুলার অদূরেই ভারতের অন্যতম প্রাচীন বৌদ্ধজনবসতি ও রাজধানী কর্ণসুবর্ণের ধ্বংসস্তূপ।
মহাদেব দাস (পোড়ামাটির ভাস্কর্য শিল্পী, যাকে নিয়ে এই লেখা) ও সমকালীন অনেক মৃৎশিল্পীরই বিশ্বাস তারা এই বাজারেও অন্যান্য পেশার প্রতিযোগিতার ভিড়ে না দাঁড়িয়ে শুধু মাটির কাজই বংশানুক্রমে করে আসছেন তার পিছনে বৌদ্ধ মতাদর্শ কাজ করছে, শুধু মতাদর্শই নয় কাজ করছে বৌদ্ধ শিল্পবোধ।
প্রাচীন মৃৎশিল্পীরা সেই সময় নিজেদের মনের রসনাকে মাটির আকারে রূপ দিতেন, কখনও তা হয়ে উঠত ছোট্ট পুতুল বা কখনও বড়ো মা কালির মূর্তি। তারপর মূর্তিপুজো যখন রাজবাড়ি , জমিদারবাড়ির বাইরেও হতে শুরু করল, পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হল। মাটির কাজের চাহিদা বাড়ল, মৃৎশিল্পীরও চাহিদা বাড়ল স্বাভাবিক ভাবেই। সেই সময় গোকর্ণ থেকে কাজের আশায় বহরমপুর এলেন ‘মধুসূধন দাস’।
মধুসূধনের এই কাজে নাম ডাক হবার পর, তিনি খাগড়া অঞ্চলে মাটির কারখানা স্থাপন করেন। তাঁর চার পুত্র সন্তান ছিল, এছাড়াও ছিল অসংখ্য অনুরাগী কারিগর। যারা মধুসূধন ও তাঁর পুত্রদের সাথে কাজ করতেন ও কাজ শিখেছিলেন। পরে তারা ছড়িয়ে পরেন বহরমপুর তথা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে, নিজেদের কারখানা তৈরি করে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে থাকেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মও আজ মৃৎশিল্পী হিসাবে স্বমহিমায়।
একালের বহরমপুরের প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী যামিনী পালের পৌত্র অসীম পাল। মাটির প্রতিমা নির্মাণে আজ দেশজোড়া তাঁদের নামডাক। শোনা যায়, এই যামিনী পালের পিতা শ্রী ভজহরি পাল, তাঁর মাটির কাজের হাতেখড়ি হয় মধুসূধনের তৃতীয় পুত্র ঋষিকেশ দাসের হাতে। শুধু তাই নয় মধুসূধনের পুত্র আশুতোষ ও হরিপদ দাস এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন তাঁদেরও সন্তানসন্তদি এবং বহু অনুরাগী মৃৎশিল্পী এই কাজকে আপন করে নিয়েছেন। আশুতোষের পুত্র ছিলেন শীতল দাস (শীতল মিস্ত্রী নামে যিনি সৈদাবাদ এলাকায় পরিচিত)। সৈদাবাদ জোড়াশিব মন্দিরের গায়ে লাগা শীতল মিস্ত্রির কারখানা এখনও আছে। শীতল পুত্র শীর্ষেন্দু দাস ও আরও অনেকে এখনও সেই কারখানাতেই কাজ করেন, অনেকেই আসেন এখানে দিনের শেষে এই আঁখরায়। সবাই যে শুধু নিজের আর্থিক চাহিদা মেটানোর জন্য আসেন তা নয়, সৈদাবাদ খাগড়া অঞ্চলে এখনও এরম মৃৎশিল্পীরও সন্ধান মেলে যারা সারাদিনের চাকরীর পরও সময় বের করে এই কারখানায় আসে শুধু নিজের হাতে মাটিকে মনের রসনায় রূপ দেবেন বলে, এটাই তাদের নেশা।
এরকমই একজন সোমনাথ চৌধুরী, পেশায় বহরমপুর আদালতের কর্মচারী এবং তার মাটির কাজের প্রতি টানের একমাত্র কারণ শীতল কাকা (শীতল মিস্ত্রী)। তাঁর কথায় –
“খাগড়ায় শীতলকাকার থেকে বড় শিল্পী নেই, হবেও না। শীতল কাকা আমাদের শিখিয়ে ছিলেন মাটি হল পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস, মাটি আমরা সর্বত্র দেখতে পাই, তাই কদর করতে পারি না। তবে আমরা যারা মাটির কাজ করি মাটি আমাদের কাছে ভগবানের দান, উপহার। তাই যখন কিছু ভালো হবে না একতাল মাটি নিয়ে বসলে সব ঠিক হয়ে যায়।”
শীতল দাস নেই আজ অনেক বছর, কিন্তু তাঁর স্মৃতি এখনও তাঁর ভক্তদের কাছে অমলিন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন শিল্পী ও দার্শনিক। তাঁর কথার টানেই সোমনাথ ও আরও অনেকে আজও আসেন শীতল মিস্ত্রীর কারখানায়।
শীতল মিস্ত্রীর অসংখ্য অনুরাগীর মধ্যেও অন্যতম একজন ভক্ত হলেন, পোড়ামাটির ভাস্কর্য শিল্পী শ্রী মহাদেব দাস। শীতল দাস (শীতলকাকা) কে তিনি আজও গুরু মানেন। আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগে সৈদাবাদ জোড়াশিব মন্দিরের পাশে শীতল মিস্ত্রীর কারখানায় হাতেখড়ি হয় মহাদেবের। তারপর সেই শুরু, মাটি মহাদেবকে কখনও ছেড়ে যায়নি। মহাদেবের কাছেও ‘মাটি ভগবানের আশীর্বাদ’ । মহাদেবের এই কাজের পেছনে রয়েছে বৌদ্ধ মতাদর্শ ও শিল্পবোধ।
মহাদেব পুরনো দিনের স্মৃতিচারণে বলেছেন – “কারখানায় যখন কাজ শুরু করি, তখন কচি বয়স। আর আজ আমি ষাট পেরিয়ে গেছি, আমার হাতে শীতলকাকা মাটি দিয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, সে মাটি আজও লেগে আছে।” মহাদেবের কথায় আরও উঠে এসেছে সেই সময়ের কথা, যখন শীতল মিস্ত্রীর তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে একের পর এক কাজ। বহরমপুর তথা সারা জেলা থেকে আসছে প্রচুর কাজের অর্ডার। জেলা এমনকি রাজ্যের বাইরেও যেতে হচ্ছে মূর্তি তৈরির কাজে। কারখানার শিল্পীরাই তাঁর পরিবার। বৃহত্তর পরিবার।
২০০০ সালের বন্যার পর, মহাদেব গঙ্গাতীরে নিয়াল্লিশপাড়ায় নিজের পরিবার নিয়ে বাস শুরু করেন। তিনি এখন বড় মূর্তি নির্মাণের কাজ আর করেন না। এখন তিনি মনোনিবেশ করেছেন পোড়ামাটির ভাস্কর্য নির্মাণে। স্বাধীনভাবে নিজের ছোট্ট ঘরেই গড়ে তুলেছেন কারখানা। সেখানে তিনি আর তাঁর স্ত্রী দুজন মিলেই মাটিতে হাত লাগান, তাদের ঘরে রয়েছে মাটি পোড়ানোর উনুন, সারাদিন মাটি নিয়েই থাকেন এই দম্পতি। মহাদেব দাস, বিশেষভাবে এই পোড়া মাটির ছোট মূর্তি বা বিভিন্ন ভাস্কর্য তৈরি নিয়ে বলেন –
“বড়ো কাজ আগে করেছি প্রচুর, বড়ো কাজেই হাত পাকিয়েছি নিজের, কিন্তু বড়ো কাজ করা ছেড়েছি কারণ, ওই কাজ করার এখন মেলা লোক, আর অর্ডার ছাড়া বড়ো কাজ করা যায় না। আমার কাছে অর্ডার আসে না বলে কি কাজ করব না? তারচেয়ে ছোট কাজ অনেক বেশি স্বাধীনভাবে করা যায়। কারো কোন চাপ থাকে না, সময়ও লাগে, বড়ো কাজের থেকে অনেক কম। ছোট কাজই করতে চাই বাকি জীবন, ছোট কাজ ভগবানের কাজ” ।
মহাদেবের বয়স এখন ষাট পেড়িয়েছে । তবুও বয়সকে হার মানিয়ে নিজের তৈরি মূর্তি বিক্রি করতে তাঁকে যেতে হয় ১০০ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগরে মুক্তি পাল, কার্ত্তিক পাল (কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী, মৃৎশিল্পের মহাজন) – এঁদের কাছে।
মহাদেব ও তাঁর পরিবারের আক্ষেপ আছে, তাঁরা মাটির কাজ করে বলে তাদের কদর নেই। মহাদেব বলেন, সোনার কাজ করলে হয়তো তাদের কদর বেশি হতো, টাকাও। আরও বলেন, কিন্তু কাজ তো কাজই, সোনা হোক বা ব্রোঞ্জ বা রুপো — আকার তো প্রথমে মাটিতেই দিতে হবে। আগে লোকের ঘরে মাটির পুতুল শোভা পেত, এখন তার জায়গা নিয়েছে ফাইবার, কাঁচ, প্লাস্টার। আর মাটির পুতুল ছাঁচে ফেলে আকার দেওয়া খুব সহজ ফলে কাজ চুরির প্রবণতাও আছে শুধু তাই নয় মাটি বলেই সরিয়ে দেয়, কাজ দেখেনা, বলে, মাটির জিনিসের এতদাম! আমাদের কাজের মজুরি নাই।
মহাদেব দাস ও এখানকার অন্যান্য মৃৎশিল্পীদের দাবী – তারা যাতে তাদের পরিশ্রমের মজুরি পান। সরকারীভাবে হস্তশিল্পের মেলা, হাট এই জাতীয় ব্যাবসায়িক উদ্যোগ নিলে, তাদের ঘরে একটু টাকা আসে।
অতিমারি পরবর্তী পৃথিবীতে তাদের অবস্থা শোচনীয়। বহরমপুরের সবচেয়ে কাছাকাছি মৃৎশিল্পের একমাত্র বাণিজ্যস্থল কৃষ্ণনগর, তা এখান থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে গিয়ে এঁদের ডজনে ডজনে নিজের কাজ বিক্রি করতে যেতে হয়, এই বয়সেও। কাজ বিক্রি হয় একদামে, তা হস্তান্তর হয় আরেক দামে। কাজের সঠিক দাম পান না শিল্পী। এই অবস্থার প্রতি তাঁরা ক্ষুব্ধ এবং একই সাথে আশাহত। মহাদেব দাসের পরিবারে তিনিই এই কাজের শেষ প্রজন্ম। প্রাচীন ও লোকায়ত শিল্পগুলি, জেলার নিজস্ব শিল্প মাধ্যমগুলি এখন অবলুপ্তির পথে। মৃৎশিল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। তবুও শেষে বলে রাখা প্রয়োজন, খাগড়া অঞ্চলের এই মাটির কাজের ও মৃৎশিল্পী দের পাশে থাকা নাগরিক হিসাবে আমাদের কর্তব্য।