আমার ছাপাখানার আমি প্রোপাইটর , কম্পোজিটর , প্রুফ রিডার আর আমি ইঙক ম্যান কেবল প্রেসম্যান আমি নই । তবে সেটি ম্যান নয় । উওম্যান।
উওম্যান বলতে এখানে তিনি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী কে বুঝিয়েছিলেন ।
উদ্ধৃটির শুরুতেই যে ছাপাখানার কথা বলা হয়েছে সেটি ‘ পন্ডিত প্রেস ‘ নামে একটি হস্তচালিত ছাপাখানা । আর যিনি উদ্ধৃতি টি তে বলেছেন তিনি আর কেউই নন , চারিত্রিক দৃঢ়তায় যাঁকে আধুনিক কালের বিদ্যাসাগর বলা যেতে পারে । মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম সুসন্তান শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। যিনি দাদাঠাকুর নামেই সমধিক পরিচিত । মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে যিনি ‘ পন্ডিত প্রেস ‘ নামে একটি হস্তচালিত ছাপাখানা জঙ্গীপুর মহকুমার রঘুনাথগঞ্জে স্থাপন করেন । তিনি তার একক প্রচেষ্টায় ‘ জঙ্গিপুর সংবাদ ‘ নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন , যে পত্রিকাকে বাংলার বলিষ্ঠ মফস্বল সাংবাদিকতার প্রথম উদাহরণ ও বলা যেতে পারে । ‘ পন্ডিত প্রেস ‘ এ তিনি ছিলেন কম্পোজিটর , প্রুফ রিডার , মেশিনম্যান সবই । শুরুতেই যা বলা হয়েছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দফরপুর গ্রামে বাস করতেন শরৎচন্দ্র পণ্ডিত । তবে জন্ম তাঁর বীরভূম জেলাতে মাতুলালয়ে । বীরভূমের নলহাটি থানার শিমলাদদি গ্রামে তাঁর জন্ম হয় দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে৷। শৈশবেই তিনি পিতা-মাতা দু’জনকেই হারান। পিতৃব্য রসিকলাল এর স্নেহ ছায়া তে তিনি বড় হতে থাকেন এরপর । চলতে থাকে পড়াশোনা । জঙ্গিপুর হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে বর্ধমানের রাজ কলেজে এফ এ ক্লাসে ভর্তি হন শরচচন্দ্র। তবে আর্থিক কারণে তিনি পড়া শেষ করতে পারেননি।
অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন শরৎচন্দ্র পণ্ডিত । তবে অত্যন্ত তেজস্বী মানুষ ছিলেন তিনি। জঙ্গিপুর সংবাদ এর পাশাপাশি তাঁর প্রকাশিত ‘ বিদুষক ‘ পত্রিকা প্রকাশিত হতো
যে পত্রিকাতে থাকত তাঁর অর্থাৎ দাদা ঠাকুরের রচিত নানা হাসির গল্প হাস্যকৌতুক ।
অল্পদিনেই বিদূষক পত্রিকা রসিকজন এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় দাদা ঠাকুর নিজের হাতে এই পত্রিকা ফেরি করতেন । সাথে মুখে থাকত চটজলদি বানিয়ে নেওয়া গান বা ছড়ার কলি যা শুনে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে যেত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ থেকে সাধারণ মানুষজন।
আই এম কামিং ফর্ম মুর্শিদাবাদ
বাট নট ফ্রম বারহাম পোর
হ্যাড আই কাম ফ্রম দ্যাট ভেরি প্লেস
অল মাইট হ্যাড শাট আপ দা ডোর
দে মাইট হ্যাড থট দ্যাট হ্যাভ কাম
ফ্রম দ্য ফেমাস অ্যাসাাইলাম
আই অ্যাবোর্ড ইন সার্চ এ প্লেস
নাউ ইজ নাউ ইন ফুল ডিসট্রেস……..
খালি গা খালি পা , এমন একজন হকার ইংরেজিতে এমন গান গাইছে রাস্তায় । এমন দৃশ্য দেখে আর গান শুনে হতবাক হয়ে যায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ আর সেই হকার টি কে উৎসাহ যোগাতে আট কপি নিয়ে নেয় সে পত্রিকা ।
প্রসঙ্গত , বলতেই হবে দাদা ঠাকুরের কাব্য প্রতিভা , রসবোধ , চটজলদি ছড়া বাঁধার এক অসাধারণ সহজাত ক্ষমতা ছিল , যে ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করেছেন বহু গুণীজন । দাদাঠাকুরের রসবোধ আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল সহজাত । ইংরেজি ভাষাতে যে উভ মুখী শব্দ আছে , সেরকম তিনি বাংলাতেও শব্দ সৃষ্টি করেছেন । হিন্দি ইংরেজিতে লিখেছেন কাব্য । তাঁর ব্যঙ্গাত্মক কবিতা গুলি ছিল তীব্র প্রতিবাদ সমাজের নানা কুপ্রথার বিরুদ্ধে। দাদা ঠাকুরের জীবিত কালেই তাঁর জীবন নিয়ে একটি ছায়াছবি নির্মিত হয় । সময়কাল ছিল ষাটের দশক।
দাদা ঠাকুরের হাস্যরসাত্মক বিষয় ছিল সর্বজনবিদিত । একবার কলকাতার হাতিবাগানে মোড়ে দাদাঠাকুর ‘ বিদূষক ‘ কাগজ বিক্রি করছেন । একদিন তাঁর পরিচিত একজন তাঁকে নিয়ে এলো থিয়েটারের ম্যানেজার অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের ঘরে ।
সে ঘরে আড্ডা দিতেন অপরের বাবু৷, জীবন বাবু , তিন কড়ি চক্রবর্তী , প্রবোধ গুহ , দানী বাবু , প্রমুখ । দাদা ঠাকুর কে দেখে দানী বাবু হাত তুলে নমস্কার করে বলেন , ” আজকাল আর চোখে ভালো দেখি না আমার প্রণাম নেবেন ” দাদা ঠাকুর দানী বাবুর পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলেন । তাই দেখে তিনকড়িবাবু বললেন , ” পণ্ডিতমশাই আমাদের দিকেও একটু কৃপা দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন । ” দাদা ঠাকুর হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন , ” গরিব ব্রাহ্মণ দানী দেখলেই তার কাছে যাই আপনার ও তিনটি মাত্র কড়ি একমাত্র বামুনের হুঁকোয় লাগানো ছাড়া আর কোন কাজে লাগে না।
পরিশেষে…. দাদা ঠাকুরের ‘ জঙ্গিপুর সংবাদ ‘ পত্রিকার কিছু অংশ ,
” আসল কথা অন্যায় যারা করে তারা বেশ ভালোভাবেই জানে পৃথিবীর মানুষ অন্যায়কে সমর্থন করবে না । তাই তারা কথার পর কথা সাজিয়ে যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে বহু ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তাদের সমস্ত কাজই ন্যায় সঙ্গত । তারা মনে ভাবে পৃথিবীর মানুষগুলো সব নির্বোধ । তারা কাজ দেখবে না কথাই শুনবে । তারা জানতে চাইবেন না পৃথিবীর মানুষগুলো কেন আজ এত কষ্ট পায় ! জানতে চাইবেন না যারা পৃথিবীতে ‘ নতুন শৃঙ্খলা ‘ আনতে চায় তাদের নিজের দেশের মানুষ গুলোই অসীম দারিদ্র্যে কেন বিপর্যস্ত ! কেন ইতালির পথেঘাটে আজ ভিখারী ভিখারিনীর ভিড় ? কেন জার্মানির লোক গুলো আজ ক্রীতদাসের জীবন যাপনে মুমূর্ষু ? কেন জাপানের লোক গুলো আজ পশুর মত প্রতিবাসীদের গাত্রে আঁচড়াতে কামড়াতে হচ্ছে অভ্যস্ত ?
উপরিউক্ত রচনাটি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় রচনার অংশ , যার প্রকাশকাল ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ বা ১৯৩৯ সাল । সংবাদপত্রটি ছিল সচিত্র সাপ্তাহিক । প্রকাশ স্থল মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার রঘুনাথগঞ্জ শহর । আর প্রত্রিকার নাম ‘ জঙ্গিপুর সংবাদ ‘ । সম্পাদক শরৎচন্দ্র পণ্ডিত । বাংলাদেশ তাঁকে অবশ্য এ নামে নয়৷
বাংলাদেশ তাঁকে অবশ্য এ নামে নয়৷, অধিকাংশ মানুষই তাঁকে চিনতেন দাদা ঠাকুর নামে৷। যে সম্পাদকীয় রচনার নির্বাচিত অংশটি উপরে উদ্ধৃত তার শিরোনাম ‘ শৃঙ্খলা না শৃঙখল ‘ আর প্রসঙ্গ অবশ্যই সে সময়ের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি।